
জাতিসংঘের তদন্ত কমিশন সাবেক স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর প্রমাণ পেয়েছে। কমিশনের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্রজনতার গণআন্দোলন দমনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার নৃশংস পন্থা অবলম্বনে সরাসরি সহায়তা প্রদান করেছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্তের ১০০ পৃষ্ঠার অধিক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করবে। সরকারের নির্ভরযোগ্য কিছু সূত্র থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারির শেষ দিকে জাতিসংঘ তাদের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের (তদন্ত কমিশন) একটি প্রতিবেদন বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠিয়েছিল। ওই সময় সরকারের কাছ থেকে এ প্রতিবেদন সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া চাওয়া হলে তা প্রদান করা হয়। এরপর প্রতিবেদনটি চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত করে জাতিসংঘ।
প্রতিবেদনে পাওয়া তথ্য সম্পর্কে সরকারের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জাতিসংঘের তদন্ত কমিশন জুলাই-আগস্টের নৃশংসতায় বিগত সরকারের প্রত্যক্ষ সহায়তার প্রমাণ পেয়েছে। বিশেষ করে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বের মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তবে কিছু ঘটনা লোকমুখে শোনা বা পুরোপুরি তথ্য-উপাত্ত প্রদান না করার কারণে, তদন্ত কমিশন পুনরায় এসব ঘটনাবলি তদন্ত করার পরামর্শ দিয়েছে। প্রতিবেদনটিতে জুলাই-আগস্টের ঘটনাগুলি এবং ভবিষ্যতে করণীয় বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, প্রতিবেদনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড গুরুত্বসহকারে তুলে ধরা হয়েছে। এতে আবু সাঈদের মৃত্যুর ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে পুলিশ তাকে গুলি করছে এবং গুলিতে তার শরীর থেকে রক্ত ঝরছে, এমন ছবি পরিষ্কারভাবে দেখানো হয়েছে। প্রতিবেদনে এও উল্লেখ করা হয়েছে যে, গুলির সময় আবু সাঈদের কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না।
এছাড়াও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে ‘গুলি করার পরও মানুষ সরে যায় না’ বলতে শোনা ওই পুলিশ কর্মকর্তার ভিডিও, রাজধানীর যাত্রাবাড়িতে পুলিশের নির্বিচারে গুলি করে মানুষ মারার দৃশ্য প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে জুলাইয়ের বেশ কিছু ঘটনার জন্য সরেজমিনে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী করা হয়েছে। এছাড়া ছাদ থেকে শিক্ষার্থীদের ফেলে দেওয়ার একটি ঘটনা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
সরকারের এক জ্যৈষ্ঠ কূটনীতিক বলেন, “মদ্দা কথায় বিগত সরকারের ওপর জুলাই-আগস্টের নৃশংসতার দায় যাচ্ছে। আগের সরকারের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে যে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয়েছে সেটি প্রতিবেদনে আছে।”
ওই কূটনীতিক আরও বলেন, “বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন উৎস থেকে যেসব তথ্য ও প্রমাণ পেয়েছে সেগুলো জাতিসংঘের তদন্ত কমিশনকে দিয়েছে। সরকারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য-প্রমাণ এবং তদন্ত কমিশন যেসব সাক্ষাৎকার নিয়েছে, সবকিছু মিলিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে তারা। আমাদের দেওয়া এবং তাদেরটা মিলিয়ে ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের ওপর ভীত্তি করে প্রতিবেদন হয়েছে। প্রতিবেদনে জুলাই-আগস্টে কি কি ঘটেছে এবং ভবিষ্যতে করণীয় নিয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলো প্রয়োজনে পুনরায় তদন্ত করার পরামর্শ দিয়েছে জাতিসংঘ।”
প্রসঙ্গত, ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর জুলাই ও আগস্টের শুরুতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো তদন্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ককে চিঠি লেখেন।
পরবর্তী পদক্ষেপে তদন্তের জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান রুরি ম্যানগোভেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি অগ্রবর্তী দল গত বছরের ২২ আগস্ট থেকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা সফর করেন। এরপর তদন্ত করার জন্য জাতিসংঘের মূল দল তথা তথ্যানুসন্ধান দল এক মাসের বেশি সময় বাংলাদেশে অবস্থান করে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গত জুলাই-আগস্টের মানবতাবিরোধী অপরাধ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ ১৫ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্ত করে। তদন্তের স্বার্থে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করেছে।