
দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো দ্রুত সংসদ নির্বাচন দিতে সরকারকে চাপে রেখেছে। ‘চাপ’ আমলে নিয়ে সরকার বলছে, ডিসেম্বর কিংবা আগামী বছরের মার্চে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন। এমন ঘোষণার পর নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতাও বেড়েছে। গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও নতুন দল গঠন করছেন। অর্থাৎ নির্বাচন কেন্দ্রিক সবার মধ্যেই ব্যাপক মাত্রায় তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনে সম্ভাব্য তিন জোট
কোন দল কীভাবে আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে, তা নিয়ে জনমনে কৌতূহল রয়েছে। দলগুলোর শীর্ষস্থানীয় নেতা ও সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে কথা বলে ধারণা করা হচ্ছে, বড় তিনটি জোট গঠন করেই নির্বাচনে অংশ নেবে দলগুলো; কিন্তু পতিত আওয়ামীলীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
দলগুলোর নির্বাচন কেন্দ্রিক তৎপরতা নিয়ে সরকারকে প্রতিবেদন দিয়েছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। ওই গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপির নেতৃত্বে ১৯টি, জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে ১১টি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত কমপক্ষে ১৫টি দলের জোট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ ছাড়া সাবেক দুই সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) ইকবাল করিম ভূঁইয়া এবং জেনারেল (অব.) আবু বেলাল মুহাম্মদ শফিউল হকসহ অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশ রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। তাদের দলে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, এনজিও প্রতিনিধি ও ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনৈতিক নেতারা যোগ দিতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তারাও হয়তো শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। সাবেক এই দুই সেনাপ্রধান এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো কথা বলেননি। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি বুঝেই তারা দল গঠনের দিকে এগোবেন বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।
এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘নির্বাচন যখন আসবে, তখন আমরা এগুলো নিয়ে কথা বলব। আমরা দলগুলো নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন করেছি। কিন্তু জোট গঠনের বিষয়ে আমরা কোনো ঘোষণা দেইনি। নির্বাচন এলে যদি প্রয়োজন হয় জোট হবে। প্রয়োজন না হলে হবে না। এটা নির্বাচন ঘনিয়ে এলে পরিষ্কার হবে। এখন সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা কঠিন।’
বিএনপির নেতৃত্বে ১৯ দল: গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে নিবন্ধিত ১৯টি দল যোগ দিতে পারে। এগুলো হলো লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), জাকের পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), গণফোরাম, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), গণঅধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) নেতৃত্বাধীন ১২ দলীয় জোট, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সংসদে আসনের নিশ্চয়তা পেলে বিএনপির সঙ্গে জোটে যাবে। এ ছাড়া সংসদীয় আসন ভাগাভাগিতে হিসাব মিললে মজিবুর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন এবি পার্টিও শেষ পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে জোটভুক্ত হতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জামায়াতের সম্ভাব্য জোট: বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে ১১টি দল। যদিও জামায়াতে ইসলামী ৩০০ আসনে নিজেদের একক প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বেশকিছু আসনে তারা এরই মধ্যে প্রার্থিতাও ঘোষণা করেছে। কিন্তু পরিস্থিতি বুঝে বড় একটি জোট গঠন করে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে চায় জামায়াত। এরই অংশ হিসেবে তারা চরমোনাই পীরের সঙ্গে বৈঠকও করেছে। অন্যান্য ইসলামী দলকেও কাছে টানতে চাইছে জামায়াত।
যে দলগুলো নিয়ে জামায়াতে ইসলামী জোট গঠন করতে চায়, সেগুলো হলো বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ জমিয়তে উলামা ইসলাম, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, খেলাফত মজলিস, ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশ ও আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি)।
এ প্রসঙ্গে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘আমরা আপাতত দলগত প্রস্তুতি নিচ্ছি। ৩০০ আসনে প্রার্থী প্রস্তুত করছি। আগামী নির্বাচন কেন্দ্রিক রাজনীতিতে নানা মেরূকরণ হবে। আমরা সেটিও বিবেচনায় রাখছি। যদি জোট গঠন করতেই হয়, সেক্ষেত্রে দেশপ্রেমিক ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দলগুলোকে নিয়েই আমরা জোট গঠন করব।’
গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীদের দলের সঙ্গে আপনাদের জোট হতে পারে কিনা এমন প্রশ্নে জামায়াতের এ নেতা বলেন, ‘তাদের সঙ্গে আমরা একসঙ্গে ফ্যাসিজমবিরোধী আন্দোলন করেছি। তারা এখনো রাজনৈতিক দল গঠন করেনি। করার ঘোষণা দিয়েছে। ছাত্ররা দেশপ্রেম থেকেই শেখ হাসিনার পতনে আন্দোলন করেছেন। আমরাও তাদের সঙ্গে ছিলাম। সুতরাং আগামীতে দেশ গঠনে যদি তাদের প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে আমাদের জোট হতে পারে। আমরা রাজনৈতিক ঐক্য নিয়েই সামনে এগোতে চাই।’
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জোট: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির গঠিত নতুন দলের নেতৃত্বেও একটি জোট গঠন হতে পারে বলে ধারণা করছে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। শিক্ষার্থীদের দলটি দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি কিংবা জামায়াতে ইসলামী নেতৃত্বেও জোটবদ্ধ হতে পারে বলে ছাত্র আন্দোলনের কেউ কেউ ধারণা করছেন। শেষ পর্যন্ত কোন দলের সঙ্গে যাবে, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, শেখ হাসিনার পতনের পরপর বিএনপি মনে করেছিল নির্বাচন তাদের জন্য সহজ হবে। কিন্তু পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হচ্ছে। এজন্য বিএনপিও নির্বাচনকেন্দ্রিক নানা হিসাবনিকাশ করে এগোচ্ছে। তারা ক্ষমতায় আসার জন্য ছাড় দিয়ে হলেও দলগুলোকে নিজেদের জোটে ভেড়াতে চাইবে। এ ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীও বসে নেই। তারাও এখন ক্ষমতার স্বপ্ন দেখছে। আবার ক্ষমতায় না যেতে পারলেও জামায়াত নিজেদের শক্তির প্রমাণ দেওয়ার জন্য জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেবে; এটা অনেকটা নিশ্চিত।
সেক্ষেত্রে জামায়াত চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশকে জোটে টানার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দল দুটিকে তারা বাগে আনতে পারবে কি না, তা নিশ্চিত নয়। কারণ জামায়াতের আদর্শের সঙ্গে এ দুই দলের মিল নেই। তারা অতীতে প্রায় সময় জামায়াতের সমালোচনা করে মাঠে-ময়দানে বক্তব্য দিয়েছে।